ধারাবাহিক নাটক সংশপ্তকে ‘হুরমতি চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বিপুল প্রশংসা লাভ করেন। ফেরদৌসী মজুমদার প্রভাবশালী শক্তিমান ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বাংলাদেশী অভিনেত্রী। স্বাধীনতা উত্তরকালে টিভি ও মঞ্চে সমান সফলতার সাথে অভিনয় করে আসছেন। তাকে নিয়ে লেখা বা তার সম্পর্কে বর্ননা করাও খুব একটা সহজ নয়।
অসম্ভব পছন্দের একজন অভিনেত্রী এবং প্রভাবশালী শক্তিমান বাংলাদেশী অভিনেত্রী একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। কিন্তু তাকে তার মতো করে খুব একটা কি পেয়েছি! তার মেধা আর প্রতিভাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।
ইডেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় তিনি তার বড় ভাই মুনীর চৌধুরী থেকে প্রস্তাব পান একটা নাটকে রোবটের চরিত্রে অভিনয় করার, যার নাম ছিল ‘ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা’। এটি লিখেছিলেন শওকত ওসমান এবং মঞ্চস্থ হয়েছিল ইকবাল হলে যা এখন জহুরুল হক হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি পাবলিক লাইব্রেরিতে ‘দন্ড ও দন্ডধর’ নাটকে অভিনয় করেন তার শিক্ষক রফিকুল ইসলামের বিপরীতে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা নাটকের ফোরামে তিনি জড়িয়ে পড়েন এবং সন্মানী হিসেবে ৭৫ টাকা পান। তারপর ফেরদৌসী মজুমদার নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা ‘তামসি’ নামক নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৭১ সালের শুরুতে তিনি পাকিস্তানের করাচীতে চলে যান একটা অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মে কাজ করতে।পরে ১১ই মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মে মাসে তার পরিবারের সবাই মুনীর চৌধুরী ছাড়া দাউদকান্দি, চান্দিনা হয়ে কলকাতা চলে যান।
তার জন্ম ১৮ জুন ১৯৪৩ (বরিশাল), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ও আরবিতে এমএ। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিক্ষকতাকে। ফেরদৌসী মজুমদার বর্তমানে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। স্বামী রামেন্দু মজুমদার ও একমাত্র সন্তান ত্রপা মজুমদার নাটকের জগতে স্বকীর্তিতে উজ্জ্বল। অনেকগুলো ভালো ভালো ছবি করতে পারেননি। আবদুল্লাহ আল-মামুন স্যারের “সারেং বউ” করতে পারেননি। তখন সংসার, স্বামী, সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকায়। “সূর্য দিঘল বাড়ী” করা হয়নি। কারণ তখন ত্রপার বয়স ছিল ৫-৬ বছর।” ৫০ বছর ধরে মঞ্চ ও টেলিভিশনে অগণিত নাটকে তার নানা ধরনের স্মরণীয় চরিত্রচিত্রণ এখনাে দর্শকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। অভিনয় করেছেন দেশের বাইরে ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে । অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেছেন একুশে পদক, জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলাে আজীবন সম্মাননা এবং ডেইলি স্টার আজীবন। সম্মাননাসহ দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। বাংলা একাডেমি তাকে দিয়েছে। সম্মানসূচক ফেলােশিপ। তিনি ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং ২০২০ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। আত্মজীবনী সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
একমাত্র সন্তান ত্রপা বলেন, মা তখন বলেছিলেন, ‘ফিল্ম করার জন্য যে সময় দিতে হয়, আমি আমার সন্তানকে ছেড়ে সেই সময়টুকু দিতে পারবো না।’ আমি আজও মাকে বলি, এটা মায়ের জীবনে অন্যতম ভুল। এটা ঠিক হয়নি। ফেরদৌসী মজুমদারের মতো মা হওয়া খুব কঠিন। এটা আমি তার সন্তান হিসেবে বলছি। কারণ আমি যখন ছোট, আমার মা ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র মতো ছবি ছেড়ে দিয়েছেন। মায়ের এমন ত্যাগের কথা সামনে এনে ত্রপা বলেন, আমার সন্তানের জন্য সেই জায়গা পর্যন্ত আমি যেতে পারবো কিনা, জানি না। তবে এটাও ঠিক, আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা হচ্ছে ‘আমি মা’! আমার সন্তানের জন্য আমি যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। সে সেভাবেই বাঙালি মনন নিয়ে বিশ্বনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠছে।
অভিনয়ে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ফেরদৌসী মজুমদারকে দেওয়া হয় আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। এ সময় মঞ্চে ছিলেন দেশবরেণ্য চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ববিতাও। ফেরদৌসী মজুমদারের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে পেরে ভীষণ খুশি ছিলেন ববিতা। তখনই তাঁর প্রিয় অভিনেত্রীকে নিয়ে বলেন, ফেরদৌসী মজুমদারের একজন ভীষণ ভক্ত, একসঙ্গে তাঁরা দুজন কাজও করেছেন। তাঁর অনেক প্রিয় একজন অভিনেত্রী ও প্রিয় মানুষের নাম ফেরদৌসী মজুমদার।কয়েক বছর আগে রহমতুল্লাহ তুহিনের নির্দেশনায় ‘যখন কখনো’ ধারাবাহিক নাটকে ফেরদৌসী মজুমদারের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন রিচি সোলায়মান এ নিয়ে রিচি সোলায়মান বলেন, ‘আমরা যারা টিভি নাটকে অভিনয় করি, তাদের অনেকেরই স্বপ্ন ফেরদৌসী আপার সঙ্গে অভিনয় করার আমারও স্বপ্ন ছিল সেই স্বপ্নও পূরণ হয়েছিল আমার। সেই বিবেচনায় বলা যায়, এটা আমার সৌভাগ্য যে আমি তার সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এমন বরেণ্য অভিনেত্রীর সঙ্গে অভিনয় করার মধ্যে ভালো লাগা কাজ করে তারা যখন অভিনয় করেন, তখন রি-অ্যাকশনে যেটাই করেন সেটাই অভিনয় হয়ে যায়। আমার অনেক বড় সৌভাগ্য যে ফেরদৌসী আপার সঙ্গে অভিনয় করতে পেরেছি।’ জনপ্রিয় অভিনেত্রী ফারজানা ছবি বলেন, আমি সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছিলাম কিংবদন্তি ফেরদৌসী মজুমদারকে। তার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে শিক্ষণীয়।
গুণী অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। এখন আগের মতো অভিনয়ে দেখা যায় না তাকে। মাঝে মাঝে বিশেষ দিবস উপলক্ষ্যে নাটকে অভিনয় করতে দেখা যায়, তাও খুব কম সংখ্যক। সম্প্রতি জাতীয় গ্রন্থমেলায় এ অভিনেত্রীর একটি বই প্রকাশ হয়েছে। বইটির নাম ‘খুঁজে পেতে’। এটি প্রকাশ করেছে বাতিঘর। এটি মূলত ফেরদৌসী মজুমদারের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ। এ প্রসঙ্গে ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘লেখা আমার নেশার মতো হলেও আমি সে অর্থে পেশাদার লেখক নই। যখন মন চায় আমার মনের কথাগুলো লিখি। এ লেখাগুলোর মধ্যে আনন্দ আছে, বেদনা আছে। আমার স্কুলের কথা লিখেছি। এক কথায় বইটিতে আছে আমার মিশ্র অনুভূতি। তার লেখা প্রকাশিত বইগুলো: যা ইচ্ছা তাই, অভিনয়জীবন আমার, মনে পড়ে, Just The Other Day, যাহা বলিব সত্য বলিব।
ফেরদৌসী মজুমদার একজন কিংবদন্তি, প্রভাবশালী শক্তিমান বাংলাদেশী অভিনেত্রী। ফেরদৌসী মজুমদারের মতো হওয়া খুব কঠিন।