তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় দাদা চমৎকার লিখেছেন। ধন্যবাদ।
ঘূর্ণিঝড় (১)
আমার জীবণে আমি কত যে ছোট বড় ঝড় ও মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছি তা গুনে শেষ করা যাবে না। তবে ঝড়ের চেহারা মাঝ সমুদ্রে একরকম আর পাড়ের কাছে নদী নালায় সমুদ্রের পাড়ে স্থলভূমিতে আর একরকম । তবে আমি যেহেতু জীবনের বেশীর ভাগ সময় সমুদ্রের বুকেই কাটিয়েছি , মাঝ সমুদ্রের সব রকম ঝড়ই বেশী দেখেছি। পাড়ের কাছের ঝড় দেখার অভিজ্ঞতা ও কয়েকটা হয়েছে । তবে একবার ১৯৮৬ সনে তাইওয়ানের কিলুং বন্দরে মারাত্মক একটা সুপার টাইফুনের পাল্লায় পড়ে, যে অভিজ্ঞতা হয়ে ছিল। তা সারা জীবনেও ভুলতে পারব না। আমরা ওই বন্দরে জাহাজে বস্তা বস্তা চাল বোঝাই করছিলাম । হঠাৎ একদিন বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের জনাল যে একটা টাইফুন ঘূর্ণিঝড় আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে । তাই জাহাজে মাল বোঝাই এর কাজ আপাতত বন্ধ রাখতে হবে। এই প্রসঙ্গে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে একটু বলি ।
-যে কোন ঝড়ের শুরু হয় নীম্নচাপ থেকে। নীম্নচাপ কি? চাপের যদি নীম্ন বলে কিছু থাকে, তাহলে উর্ধ বলেও কিছু আছে নিশ্চই? জল যেমন গড়ায় উপর থেকে নীচে, হাওয়াও তেমনি বয় উর্ধচাপ থেকে নীম্ন চাপে। চাপ কি? বায়ু স্তরের চাপ, মাপা হয় ব্যারোমিটার দিয়ে। নীম্নচাপ কি? স্ট্যান্ডার্ড চাপের থেকে বা স্বাভাবিকের থেকে নীম্ন হলেই তাকে নীম্নচাপ বলা হবে। স্বাভাবিক কি ? আবহাওয়া দফতর থেকে সারা পৃথিবীর সব অঞ্চলের মাসিক স্বাভাবিক বায়ু চাপ ও তাপমাত্রার একটা তালিকা তৈরি করেছেন সেটাই স্বাবাভাবিক। বয়স অনুসারে শরীরের স্বাভাবিক রক্তচাপের মতো।
তবে সব নীম্ন চাপই কিন্তু ঝড় বা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় না। কেন হয় না? কারন ঘূর্ণিঝড় হতে গেলে তার কেন্দ্র বিন্দুকে কেন্দ্র করে চক্রাকারে নীম্নচাপ থাকবে। কেন্দ্রটিতে সর্বনীম্ন থাকলেও তাকে ঘিরে চক্রাকারে নীম্নচাপ রেখা থাকবে।
ঝড় মাত্রই মারাত্মক হলেও ঘূর্ণিঝড় কিন্তু সব থেকে মারাত্মক। মাঝ সমুদ্রে ও মারাত্মক, কিনারা বা স্থলভূমিতেও মারাত্মক। এই মারাত্মক হওয়ার প্রধান কারণ ঘূর্ণিঝড়ের চরিত্র । এক তো এর হাওয়ার গতিবেগ অন্য ঝড়ের থেকে বেশী হয়, তারপর সেই ভয়ঙ্কর গতিবেগ সম্পন্ন হাওয়া একটা বিশাল জায়গা নিয়ে ক্রমাগত চক্রাকারে ঘুরতে থাকে । অন্য ঝড়ে বড়ো বড়ো গাছের ডাল পালা ভাঙ্গতে পারে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় তাকে সমূল মাটি থেকে উপড়ে ফেলতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের একটা কেন্দ্র বিন্দু থাকে । সেই জায়গাটা নিঃসন্দেহে সবথেকে মারাত্মক। কিন্তু সেই কেন্দ্র বিন্দু থেকে হাজার হাজার মাইল দূরেও ঝড়ের তাণ্ডব চলতে পারে। তবে সেই তান্ডবের মাত্রার তারতম্য থাকবে। শুধু তাই নয় কেন্দ্র থেকে দূরত্ব অনুযায়ী আবহাওয়ার তারতম্য হবে। কোথাও বজ্র বিদ্যুৎ সহ ভারী বৃষ্টি হবে। কোথাও হালকা থেকে মাঝারী বৃষ্টি পাত হবে।
এবার বলি কিলুং বন্দরে কি হয়েছিল। কোথাও কিছু নেই ঝড় আসার তিন দিন আগে বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের কাজকর্ম বন্ধ করে দিতে আমরা পড়লাম মহা বিপদে। জাহাজে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকলে সময় কাটে না। সেটাও এক ধরনের লক ডাউন। এদিকে শুধু জাহাজে বা বন্দরেই নয় পুরো শহরে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্ত অফিসে স্কুলে কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে । দোকান পাট হাট বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় লোক বা গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল থেকে টিভি আর রেডিওয় সমানে ঝড়ের বুলেটিন প্রচার করা হচ্ছে। আর সাবধান বানী হিসাবে বলা হচ্ছে- বাড়ি থেকে একদম বের হবেন না। জানালা বারান্ডা বা ছাদে , উড়ে যেতে পারে এমন কোন জিনিস রাখবেন না। ফ্রিজে ও বাড়িতে পর্যাপ্ত পানিয় জল দুধ ও খাবার মজুত করে রাখুন। বড়ো বড়ো বাড়িতে লিফট ব্যবহার করবেন না। ঝড় এসে পড়লে কারেন্ট চলে গিয়ে ব্ল্যাক আউট হয়ে যেতে পারে। তার জন্য মোমবাতি দেশলাই টর্চ প্রস্তুত রাখবেন।
কিন্তু জাহাজে বসে বসে এসব শুনতে কতক্ষণ ভালো লাগে? আমরা কজন জাহাজ থেকে বেরিয়ে ছিলাম। কারন মূল ঝড় আসতে তো এখনো তিন দিন বাকি। কিন্তু জাহাজ থেকে নামা মাত্র বন্দর পুলিশ আমাদের আটকাল। এবং জাহাজে ফিরে যেতে বলল । তারপর আর কি খেয়ে বসে টিভি দেখে আর রেডিও শুনেই আমাদের সময় কাটাতে হ’ল। কিন্তু মূল ঝড়টা যেদিন রাতে জাহাজের উপর আছড়ে পড়ল , আমি একা সে রাতে নাইট ডিউটিতে ছিলাম। খাঁড়ির ভিতরে সমুদ্রের জল ঝড়ের দাপটে বাসুকি সাপের ফনার মতো দশ পনের ফুট লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল । বন্দরের গায়ে বাঁধা অবস্থায় ও জাহাজটা মোচার খোলার মতো দুলছিল। আমার প্রতি মুহূর্তে ভয় করছিল যে এই বুঝি জাহাজের সব দড়ি দড়া ছিঁড়ে সে ভেসে বেরিয়ে যায়। সবথেকে ভয়াবহ ছিল কাঁচের জানালার উপর ঝড়ের দাপটে গোঁ গোঁ শব্দ। সে গুলোও মনে হচ্ছিল যে এই বুঝি ভেঙ্গে পড়ে। মাঝ রাতে এক সময় আমি জাহাজের গ্যালি বা বড়ো রান্না ঘরটায় ঢুকে ছিলাম কিছু খাবারের সন্ধানে । রান্না ঘরের সমুদ্রের দিকের কাঁচের জানালার ওপর ঝড়ের এমন গোঁ গোঁ আওয়াজ উত্তর উত্তর বাড়ছিল যে এক সময় আমার মনে হয়েছিল যে কাঁচের জানালাটা বুঝি ভেঙ্গে পড়বে। আমি কানে আঙ্গুল দিয়ে সটান মেঝেতে শুয়ে পড়ে ছিলাম।
এই তাণ্ডব সারা রাত ধরে চলেছিল।সব থেকে ভয়াবহ ছিল আমাকে একা এই ঘটনার সাক্ষী থাকতে হয়েছিল । আর একজনও কেউ তাদের কেবিন থেকে বের হয়নি । তাই সেই সময় আমি কারো সাথে আমার ভয়ের অভিজ্ঞতাটা ভাগ করে নিতে পারিনি। তাও পরে শুনেছিলাম যে মূল ঝড়টা নাকি জাহাজ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূর দিয়ে গেছে। ঝড় চলে যাবার পরে আমরা জাহাজের খোলে দেখি জল ভরে গেছে। সেই জল পাম্প করে বের করতে হ’ল। অনেক বস্তা চাল ও জলে ভিজে খারাপ হয়ে গিয়ে ছিল।
ঘূর্ণিঝড় (২)
আর একটা সুপার সাইক্লোনে পড়েছিলাম উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে । আমি তখন সেকেন্ড অফিসার। একটা জাহাজ নিয়ে আসছিলাম আমেরিকার ইস্ট কোস্ট থেকে পানামা খাল হয়ে, যাব জাপানে । সময় টা ছিল ডিসেম্বর মাস। কোন মাসে কোন সমুদ্র কেমন থাকে, কোথায় কখন ঝড়ের সম্ভাবনা বেশি থাকে, কোথায় কখন কি ধরনের আবহাওয়া চলে, এগুলো জাহাজের সব নেভিগেটরদের জানতে হয়। এই সময়ে যেহেতু উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবল ঝড়ের সম্ভাবনা থাকে, তাই আমি জাহাজের রুট তৈরি করেছিলাম দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপের দক্ষিণ দিয়ে। কিন্তু জাহাজ পানামা খাল পার হয়ে যখন গালফ অফ পানামায়, তখন অফিস থেকে তার এলো যে করে পারো ,যতো তাড়াতাড়ি পারো জাহাজ কে জাপানে নিয়ে এসো। ক্যাপ্টেন আমায় ডেকে বললেন – সেকেন্ড মেট, আমরা যদি রাম্ব লাইন সেইলিং না করে , গ্রেট সার্কেল করে যাই তো দূরত্ব কতটা কমবে ? আমি বললাম হিসেব করে বলছি স্যার।
রাম্ব লাইন সেইলিং হ’ল জাহাজ যখন সমুদ্রের উপর দিয়ে সোজা রাস্তায় সরল রেখায় এক বন্দর থেকে আর এক বন্দরে যায়। আর গ্রেট সার্কেল হ’ল জাহাজ যখন সেই একই যাত্রা পথকে ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করে বক্র রেখায় যায়। এই ভাগ করার অর্থ , পৃথিবীর বক্রতাকে কাজে লাগান। এই যাত্রা পথ যদি পূর্ব পশ্চিম বা পশ্চিম থেকে পূর্বে হয় তো দূরত্ব অনেকটাই কমে যায়। তবে তাতে সমস্যা হ’ল জাহাজকে অনেক উপরের দিকে বা হায়ার ল্যাটীটুইডে উঠতে হয়,আর খারাপ আবহাওয়ায় পড়তে হয়। ফলে জাহাজের গতি কমে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সময় বেশিই লেগে যায়। তাছাড়া জাহাজকে খারাপ আবহাওয়ার দরুন ঘন ঘন বিপদে পড়তে হয় । কথাটা আমি ক্যাপ্টেন সাহেবকে বললাম। কিন্তু তিনি হেসেই উড়িয়ে দিলেন। হ্যাঁ রোজ রোজ তোমার জন্য সেখানে ঝড় উঠছে ? আর উঠলেই বা কি ? অতই যদি ঝড়ের ভয় তো জাহাজে এসেছ কেন? বাড়িতে থাকলেই পারতে । আমি বলছি, জাহাজ ওই গ্রেট সার্কেল করেই যাবে। তুমি সেই মতো রুট প্ল্যান তৈরি কর। আমি তখন ছোট অফিসার ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি না। তাঁর আদেশ অনুযায়ী জাহাজের রুট তৈরি করলাম । এবং সেই মতো জাহাজ চলল । দিন চারেক জাহাজ চলার পর ডান দিকে প্রথমে মেক্সিকো তারপর উত্তর আমেরিকার স্যানফ্র্যানসিসকো ছেড়ে আর একটু উপরে উঠতেই সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল। এক একটা তিন তলার সমান উচ্চতার বিশাল ডেউ এসে ব্রীজফ্রন্ট (জাহাজের পরিচালন কেন্দ্র বা জাহাজকে যেখান থেকে পরিচালনা করা হয় ,তাকে জাহাজের ব্রীজ বলা হয় । তার সামনের দিকের কাঁচের জানালাকে ব্রীজফ্রন্ট বলা হয় । জায়গাটা জাহাজের সব থেকে ওপরে থাকে,) বাল্কহেডের (দেয়াল) কাঁচের জানালার উপর আছড়ে পড়তে লাগল। জাহাজ সাংঘাতিক ভাবে দুলতে থাকল।
– এবার যে রাতে আমরা ঝড়ের কেন্দ্র স্থলে ঢুকে পড়ি, সেদিন দুপুর থেকেই আবহাওয়ার সাংঘাতিক অবনতি হয় ।ব্যারোমিটারে দেখি বায়ু স্তরের চাপ ভয়ঙ্কর ভাবে নীচে নামছে। বিকেলে আমি রেলিং ধরে ধরে ব্রিজ থেকে নীচে নেমে এলাম। জাহাজ বেশি দুললে অনেকে খেতে পারে না। অনেকের খুব বমি হয়। একে সীসিকনেস বলে। আমি আর জন্মেও বোধহয় সেলার ছিলাম। আমার খিদে বেড়ে যায়। বমি টমি হয় না। আর ঘুমও খুব ভালো হয়। কারন আমার মা মনে হয় জানতেন যে আমি জাহাজে যাব, তাই ছোট বেলায় দোলনায় শুইয়ে দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়াতেন (আপনি ও যদি আপনার ছেলেকে জাহাজে পাঠাতে চান তো দোলনায় ঘুমন অভ্যাস করাবেন)। রাত তখন কটা হবে জানি না। দুলুনির মধ্যেই বেশ ঘুমচ্ছিলাম, কেন জানি না হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কেবিনে গরম বেড়ে যাওয়ায় বুঝলাম এসি বন্ধ হয়ে গেছে। জাহাজ অসম্ভব জোরে দুলছে। আমার জাহাজী জীবন শুরুই হয়েছে ঝড়ে পড়ে। কাজেই ঝড় ঝাপ্টা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। জাহাজ ডুবির গল্পও এতোই শুনেছি যে সদা সর্বদা তার জন্য তৈরি থাকি। ঝড়ের মধ্যে রাতে ঘুমতে গেলে স্লিপিং স্যুট না পরে বয়লার স্যুট( জাহাজের কাজ করার পোশাক) পরে শুই। আর হাতের কাছে লাইফ জ্যাকেটটা রাখি। যাতে জাহাজ ছেড়ে লাইফ বোটে উঠতে বেশী সময় নষ্ট না হয় ।
– যাইহোক ঘুম ভেঙ্গে উঠে, বিছানা থেকে নামতেই পা ঢুবে গেল জলে। জল খুব বেশি নয়, গোড়ালি ঢুব। কিন্তু আমার কেবিন তো জলের লেভেল থেকে অন্তত পনের ফুট উচুতে। এখানে জল এসে যাওয়া মানে তো জাহাজ ঢুবছে ! না তা হতে পারে না। কারন তাহলে তো জাহজ এভবাবে এতো জোরে দুলত না। অন্ধকার ঘরে জলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম। হঠাৎ বিশাল জোরে জাহাজটা দুলে উঠল। আমি টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। তারপর আস্তে আস্তে এটা সেটা ধরে উঠে দাঁড়ালাম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে ফেলে দরজার কছে গিয়ে আলো জ্বালতে গেলাম। কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছুতে পারলাম না। দরজার সামনে বাক্সের মতো কি একটা আড়া আড়ি ভাবে পড়ে আছে। তার গায়ে হাত বুলিয়ে বুঝলাম যে সেটা আমার ফ্রীজ।জাহাজের দুলুনিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাকে টেনে সরিয়ে দরজার কাছে আলোর সুইচ জ্বাললাম। কিন্তু আলো জ্বলল না। দরজাটা খোলার চেষ্টা করলাম, খুলতে পারলাম না। দরজার ল্যাচটা এমন ভাবে লক হয়ে গেছে যে টানাড়ানি ধাক্কা ধাক্কিতে খুলছে না। এখন যদি জাহাজ ঢোবে তো কেবিন ছেড়ে বের হতেই পারব না। জাহাজের সঙ্গেই ঢুবে মরতে হবে। না এই সময় ভয় পেলে বা ঘাবড়ে গেলে চলবে না। মাথাটা খাটাতে হবে। ইয়েস দি আইডিয়া দরজার নীচে ফায়ার এস্কেপ আছে, ওটা দিয়ে বের হওয়া যাবে। কাজটা ভাবা যত সহজ কাজে তত নয়। এই কাজটা করতে গেলে প্রথমত আমায় মেঝেতে জলের উপর শুয়ে পড়তে হবে। কারন ফায়ার এস্কেপটা দরজার একেবারে নিচে, ছোট্ট একটা খোপ। যেখান দিয়ে একজন মাত্র মানুষ কোন রকমে গলে বের হতে পারে। বেশ হাঙ্গামা করে সেটা ভেঙ্গে, হামা গুড়ি দিয়ে সেখান দিয়ে বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখলাম, দরজার বাইরে এ্যালিওয়েটা অন্ধকার, আর জলে থৈ থৈ করছে। সেই জলে কি সব ভেসে বেড়াচ্ছে। আর জাহাজের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রচন্ড বেগে ডান দিক থেকে একবার বাঁ দিকে, আবার বাঁ দিক থাকে ডান দিকে দৌড়াচ্ছে। আমার কেবিনটা স্টার বোর্ড সাইডের (ডান দিকের) একেবারে শেষ মাথায়। ফলে জাহাজ যখন বাঁ দিকে কাৎ হবে, সেই সময় আবার ডান দিকে হেলবার আগে আমায় বেরিয়ে পড়তে হবে। এমনিতে স্বাভাবিক সময়ে এই কাজটা মোটেই শক্ত কিছু নয়।কিন্তু এরকম সাঙ্ঘাতিক ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রী দুলুনির মধ্যে কাজটা বেশ শক্ত। তারপর আমার বডির যা সাইজ, বের হতে গিয়ে গর্তে ফেঁসে গেলেই হয়েছে। এখন প্রশ্ন হ’ল আমি কি উপুড় হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বের হ’ব? না কি চিৎ হয়ে শুয়ে বের হ’ব? বুকে হেঁটেই বেরুনর নিয়ম। কিন্তু সেটা করতে গেলে নাকে মুখে জল ঢুকে যাবার সম্ভাবনা। এমনিতে জল বেশি নেই কিন্তু জাহাজ যখন ডান দিকে হেলে কাৎ হয়ে যাচ্ছে, সব জলটা এদিকে গড়িয়ে এসে এক হাঁটু অবধি হয়ে যাচ্ছে। ফলে বুকে হেঁটে ক্রল করতে গেলে এখানেই ডুবে মরতে হবে। অতএব চিৎ হয়েই বের হতে হবে। এবার প্রশ্ন পা আগে না মাথা আগে। কি ভাবে বের হব? মাথা টা আগে বের করলে সুবিধা হ’ল, মাথা বের করে বাইরে টা দেখতে পাব। কিন্তু অসুবিধা হ’ল , জাহাজটা বাঁ দিকে হেলবার আগে যদি বেরিয়ে না পড়তে পারি তো ঐ বড়ো বড়ো যে জিনিষ গুলো ভেসে ডান দিক বাঁ দিক করছে, তাদের নীচে চাপা পড়ব। তারা আমার মাথা গুঁড়িয়ে দেবে। আর ভাবতে পারছি না। জাহাজ যেই না বামে হেলেছে, গর্তটা দিয়ে প্রথমে মুন্ডুটা বের করলাম। তারপর গায়ের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে কাঁধ পিঠ কোমর এক ঝটকায় বের করে ফেললাম। হাঁটুও বেরিয়ে এলো। এবার জাহাজ সিধে হচ্ছে, ডান দিকে হেলে পড়ার আগে বেরিয়ে যেতে হবে। গোল বাঁধল পায়ের শেষ প্রান্তে , পাতলুনের শেষ প্রান্ত আটকে গেল দরজার একটা পেরেকে। প্রচণ্ড জোরে পা ছুঁড়ে ধস্তা ধস্তি করে ঠিক সময়ে সরে যেতে পারলাম। নাহলে এই ঘটনাটা বলার জন্য বেঁচে থাকতাম না। সামনেই উপরে উঠার সিড়ী, এক লাফে সেটায় চড়লাম। এবার যে বড়ো বড়ো জিনিষ গুলো জলে ভেসে এ্যালিওয়ে দিয়ে ডান দিক বাঁ দিক করছে , তাদের দেখলাম। একটা বড়ো ওয়াস বেসিন আর একটা ওয়াসিং মেশিন। এগুলো বাঁ দিকের কমন টয়লেট থেকে উপড়ে বেরিয়ে এসেছে। জলও সেখান থেকেই আসছে। যাইহোক এবার সিঁড়ী বেয়ে উপরে গিয়ে ঢুকলাম ব্রীজে। জাহাজ বা যে কোনো জিনিষ যখন দোলে, সেই দুলুনিটা নিচের থেকে উপরে বেশি টের পাওয়া যায়। ঝড়ে যখন নারকেল গাছ দোলে, দেখবে মাথাটা নুয়ে নুয়ে পড়ে। জাহাজেরও তাই হয়। ওই মহা প্রলয়ে ব্রীজের অবস্থা তখন, এক কথায় সাংঘাতিক। ব্রীজের দরজায় দাঁড়িয়ে কি দেখলাম? প্রথমে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তারপর অন্ধকারের সঙ্গে চোখটা একটু সয়ে নিয়ে দেখলাম, একজন সুকানি হুইল ধোরে স্টিয়ারিং করছে, থার্ড মেট তাকে ধরে আছে। নাহলে সে ওই দুলুনিতে দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারবে না। ছিটকে পড়ে যাবে। ক্যাপ্টেন ব্রীজ ফ্রন্টের জানালার সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে। আর একগাদা ছোটো ছোটো জিনিষ জাহাজের দুলুনির সঙ্গে ডান দিক বাঁ দিক প্রচন্ড জোরে দৌড় দৌড়ি করছে। সেই ছোটো জিনিষ গুলোর মধ্যে ছিল বেশির ভাগই অত্যন্ত দরকারি সব বই কগজ পত্র ফাইল আর ছোটো খাটো টুকটাক কাপ ডিশ চায়ের কেটলি, এইসব নিরীহ জিনিষ পত্র। কিন্তু তারাই ওই মহাপ্রলয়ে পড়ে মারাত্মক আকার ধারন করেছে। তাদের জন্য আমি এক পাও এগুতে পারছি না। এই তারা ডান দিকে ছুটছে তো পরের মুহূর্তে ছুটে বাঁ দিকে চলে আসছে। একটা দুটো হ’লে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কায়দা করা যেত , এতো প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটা। আমি ব্রীজে ঢুকতে পারলাম না। দরজায় দাঁড়িয়ে এক মিনিট চিন্তা করলাম কি করা যায়? কারন কিছু তো একটা করতে হবে, নাহলে এই ছোটো জিনিষ গুলোর আঘাত ও মারাত্মক হতে পারে। দরজায় দাঁড়িয়েই ক্যাপ্টেনকে বললাম স্যার আমি নিচে যাচ্ছি , গ্যালি থেকে গারবেজ ব্যাগ আনতে। এই স্মল ফ্লায়িং অবজেক্ট গুলোকে বস্তা বন্দী না করলে তো এখানে দাঁড়ান যাবেনা ।ক্যাপ্টেন বললে যাও আর চীফ মেটকে ডেকে আন। সুকানি বললে অন্য একজন সুকানিকে ডেকে আনুন স্যার, আমি আর পারছি না। আমি সেই দুলুনির মধ্যে সিঁড়ির রেলিং আর দেয়াল ধরে ব্যালেন্স করে এক পা এক পা করে নেমে চীফ অফিসারের কেবিনে গেলাম। কেবিনের দরজা হাট করে খোলা তিনি বা তাঁর স্ত্রী ঘরে নেই। ইঞ্জিনিয়ারদের ঘর গুলোও ফাঁকা। এবার নীচে নেমে গ্যালিতে যেতে গিয়ে অফিসারস মেস রুমে উঁকি মেরে দেখি, চীফ অফিসার আর তাঁর স্ত্রী এক কোনে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। চীফ অফিসারের স্ত্রী বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম – স্যার ক্যাপ্টেন আপনাকে ব্রীজে ডাকছেন। চীফ অফিসার একটা অস্বাভাবিক ধরা ধরা গলায় বললেন – আমি ব্রীজে গিয়ে কি করব? জাহাজ এখন একটা সুপার স্টর্মের আইয়ে মানে কেন্দ্রে পড়েছে । স্বয়ং ভগোবান না বাঁচালে কেউ বাঁচবে না। ঘূর্ণি ঝড়ের কেন্দ্র থেকে কেউ বেঁছে ফেরেনা।আমি বুঝলাম উনি যাবেন না। ক্রু মেশ রুমে গিয়ে দেখি ক্রুরা সব একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সাক্ষাৎ মৃত্যু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ভয়ে বিহ্বল হয়ে কাঁপছে। তাদের মুখ অবর্ণনীয় ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে। এই দেখে আমার কিন্তু রাগ হয়ে গেল। চীফ অফিসারের সঙ্গে তার বৌ বাচ্চা ফ্যামিলি আছে। ফলে তার কথা আলাদা। সে এই সময়ে দুর্বল হয়ে পড়তেই পারে, কিন্তু তাই বলে এই হাট্টা কাট্টা জোয়ান সীম্যানের দল কেন ভেঙ্গে পড়বে? সীম্যানের কাজই তো হ’ল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করা। হেরে গেলে চলবে ? আমি খুব কড়া গলায় বললাম – ব্যাপারটা কি আপনাদের ? জাহাজে এই সময় এতো জরুরী সব কাজ রয়েছে, সে সব ফেলে আপনারা এখানে বসে বসে মেয়েদের মতো কাঁদছেন ? শক ট্রিটমেন্টে কাজ হলো। কান্না থামিয়ে উদাস ধরা গলায় সারেঙ বললে – এখন আবার কি কাজ স্যার? আর একজন বললে – কাজ করেই বা কি হবে? সেই তো জাহাজ ডুববেই। আর আমরা সবাই মরব। ক্রুরা যখন এই সব বলছে, ওই টুকু সময়ের মধ্যে আমি ঠিক করে নিয়েছি যে কি করতে হবে। এই লোক গুলোকে কাজে ব্যস্ত না রাখলে এরা এখানে বসে বসে মরার চিন্তা করতে থাকবে, আর অন্য লোকেদের মরাল নষ্ট করে কাজের পরিবেশটা নষ্ট করে দেবে। আমি বললাম –শুনুন আমি এখন ব্রীজ থেকে আসছি । পরিস্থিতি আপনারা যতটা খারাপ ভাবছেন, এখনও সে রকম কিছু হয়নি। কিন্তু হবে। আপনারা বা আমরা যদি হাত গুটিয়ে বসি তো পাঁচ মিনিটে জাহাজ জলের তলায় চলে যাবে। একজন সুকানি বললে – আমরা কি করতে পারি ? – বেশ ভালো কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। বেশি কথা বলার এখন সময় নেই। সর্টে বলছি শুনুন। আমরা পড়েছি একটা মহা শক্তিশালী ঝড়ের কেন্দ্রে। এখান থেকে বের হতে গেলে দুটো জিনিষ চাই। এক হ’ল ইঞ্জিনকে চালু রাখা আর ঠিক মতো স্টিয়ারিং করা। এই দুটো এখনও ঠিক চলছে তাই জাহাজ ডোবেনি। আমরা সবাই বেঁচে আছি। এই দুটো ঠিক রাখতে পারলে কালও জাহাজ ঠিক থাকবে। ঝড় তো আজীবন কাল চলবে না। হঠাৎ বেগে এসেছে আবার হঠাৎ ই চলে যাবে। কে বলতে পারে এক ঘণ্টা পরেই চলে যেতে পারে। কিন্তু এখন আপনারা যেমন হাত গুটিয়ে বসে আছেন, সবাই যদি ভেবে নেয় যে জাহাজ তো ডুববেই তাহলে এই মুহূর্তেই জাহাজ ডুবে যাবে। কেউ রুখতে পারবে না। এখন আপনারাই বলুন কি করতে চান? আমার সঙ্গে এসে কাজ করবেন, না এখানেই বসে বসে মৃত্যু কে ডেকে আনবেন। ভোকাল টনিকে মুহূর্তের মধ্যে কাজ হ’ল। সবাই উঠে এক পায়ে খাড়া হয়ে গেল। -বলুন কি করতে হবে ? -ওপরে আমার ঘরের সামনেটা জলে ভাসছে। দেখুন জল কোথা থেকে আসছে। সেটা বন্ধ করুন। সাবধানে যাবেন দুটো বড়ো বড়ো জিনিষ কিন্তু লুজ হয়ে দৌড়চ্ছে। তাদেরও সরাতে হবে। চার জন আমার সঙ্গে ব্রীজে চলুন। গ্যালি থেকে গারবেজ ব্যাগ নিন, ব্রীজ পরিষ্কার করতে হবে। না হ’লে স্টিয়ারিং করা যাবে না। একজন সুকানি এখুনি ব্রীজে চলুন। স্টিয়ারিং করতে হবে। বাকীরা এ্যাকমোডেশনের সব ওয়াটার টাইট ডোর আর পোর্ট হোল গুলো চেক করুন। দেখুন কোথাও জল ঢুকছে কিনা। খবরদার কেউ ডেকে বা খোলা জায়গায় জাবেন না। এই বলে ক্রুদের সবাইকে কাজে লাগিয়ে,ওদের মধ্যে থেকে চারজনকে নিয়ে ব্রীজে এলাম। ব্রীজে ফিরতেই ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করল চীফ মেট কৈ ? উনি আসতে চাইলেন না। ক্যাপ্টেন কিছু বললেন না। এবার একটা জিনিষ লক্ষ করলাম যে হাওয়ার গতি কমে গেছে। মেঘ মুক্ত পরিষ্কার আকশে তারাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ঢেউ এর আকার আরও মারাত্মক রকম উঁচু হয়েছে। বিশাল বিশাল ঢেউ বিভিন্ন দিক থেকে ধেয়ে এসে জাহাজের ঊপর আছড়ে পড়ছে। এক একটা ঢেউ এর আকার এতোই বিশাল হচ্ছে যে তার সামনে জাহাজটাকে ছোট্ট একটা খেলনার নৌকা বলে মনে হচ্ছে। আর আমাদের বড়ো জাহাজটা দুলছে মোচার খোলার মতো। ব্রীজ ফ্রন্টের কাঁচের জানালা গুলোর ওপর একটার পর একটা বড় বড় ঢেউ এসে এমন ভাবে এসে আছড়ে পড়ছে, যে মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে কাঁচ ভেঙ্গে জল ব্রীজে ঢুকে পড়বে। জাহাজের স্পিড কমতে কমতে দু এক নটে দাঁড়িয়ে গেছে। (ট্রপিক্যাল রিভলভিং স্টর্ম বা সুপার সাইক্লোনের কেন্দ্রের আভাওয়া এইরকম ই হয় ) আমরা কাজ করব কি সোজা হয়ে এক জায়গায় দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছি না। এক একটা বিশাল ঢেউ এর ধাক্কায় জাহাজ যখন কাৎ হয়ে পড়ছে, আমরা ব্রীজের থাম বা অন্য কিছু ধরে দাঁড়িয়ে পড়ছি। নাম কা ওয়াস্তে স্টিয়ারিং হচ্ছে, কিন্তু আদৌ কিছু হচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। হঠাৎ একটা বিশাল ঢেউ জাহাজের বাঁ দিক থেকে, আর আর একটা ঢেউ সামনে থেকে এসে একসঙ্গে এমন জোরে ধাক্কা মারল যে জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। জাহাজ ডান দিকে হেলে কাৎ হয়ে প্রায় শুয়ে পড়ে বোঁ করে ডান দিকে পাক খেয়ে ঘুরে গেল। ক্যাপ্টেন ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন- একি ইঞ্জিন বন্ধ হ’ল কেন? বাকি ক্রুরা ভয় পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
– না আমি মিথ্যা কথা বলব না। আমি সেই সময় ভয় পেয়ে কোন ঠাকুর দেবতাকে ডেকে প্রান ভিক্ষা চাইনি। আমার শুধু চোখের সামনে আমার মায়ের আর মেয়ের মুখটা ভেসে উঠে ছিল। মিনিট দুই পরে জাহাজের ইঞ্জিন চালু হয়। ইঞ্জিনটা ওই অবস্থায় বন্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু চালু হওয়াটা নয় । একটা বন্ধ ইঞ্জিন ওই অবস্থায় নিজের থেকে কিভাবে চালু হয়েছিল বা কে চালু করেছিল তা কেউ জানে না।স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া কেউ হতে পারে না। কিন্তু যাইহোক আমরা বেঁচে গেলাম।
# ঘূর্ণিঝড় (৩)
এর আগে পানামা খাল থেকে জাপানে যাওয়ার পথে বেরিং সী এর দক্ষিনে কানাডার পশ্চিমে যে ঘূর্ণি ঝড়ে পড়ে ছিলাম তার কথা লিখে ছিলাম। অনেকে জানতে চেয়েছেন যে তার পরে কি হ’ল ? এখন আমারও মনে হচ্ছে সেটা লেখা দরকার যে তার পরে কি হ’ল ? তার পরে যেটা হয়ে ছিল , তা যে খুব ভয়ঙ্কর বা মারাত্মক তা নয় , তবে খুব খারাপ। জীবনের ওপর দিয়েও যখন একটা বড়ো ঝড় বয়ে যায় , মানুষ বেসামাল হয়ে পড়ে। ঝড় তা সে যত মারাত্মকই হউক বা যতক্ষণই চলুক একসময় সে থামে। তখন জীবন আবার নতুন খাতে বইতে শুরু করে। তারপর আসে তার উত্তর বা পরবর্তী পরিস্থিতি । আমাদের সেই জাহাজে ওই ঘূর্ণি ঝড়ের পরবর্তী পরিস্থিতি খুবই মর্মান্তিক হয়ে ছিল। সাধারন সময়ে জাহাজে আমরা যা কাজ করি সে তুলনায় কাজ বেড়ে গেল দশ গুন। এক তো প্রথমে আমাদের জাহাজে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ক্ষয় ক্ষতি দেখতে হ’ল। জাহাজটা ছিল কন্টেনার শীপ। সেই ঝড়ের রাতে চল্লিশটি কন্টেনার জলে পড়ে যায়। জাহাজের বেশীর ভাগ কম্পিউটার অকেজ হয়ে পড়েছিল। তাই কাজ করতেও খুব অসুবিধা হচ্ছিল। খাবার দাবারের স্টোরে যেন একটা মত্ত হাতি তাণ্ডব চালিয়েছে। জাহাজে কাঁচের কাপ ডিস বাসন কোষন একটা আস্ত ছিল না। কটা মাত্র প্লেট আস্ত ছিল, তাতেই আমরা ভাগ করে খাওয়া দাওয়া করছিলাম। এর মধ্যেই অফিসের হুকুম অনুযায়ী যা যা ক্ষতি হয়েছে তার তালিকা তৈরি করে বিভিন্ন অফিসে পাঠাতে হ’ল। আধ পেটা খেয়ে আমরা মরছি নিজের জ্বালায় আর ওফিস থেকে বাবুরা নিত্য নতুন প্রশ্ন পাঠাতে লাগল ।
ওই ঘটনার এক মাস পরে আমি নিজের টাকায় বাড়ি ফিরে এসে ছিলাম । কারণ কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। আমার লেখা পড়ে আপনাদের মনে হতে পারে যে আমি খুব সাহসী ও ওই সময়ে আমি একটুও ভয় পাইনি। তা কিন্তু ঠিক নয় । আমি ঝড়ে পড়ে ভয় পেয়ে ভেঙ্গে পড়িনি বা উপস্থিত বুদ্ধি হারাইনি বটে, তবে খুবই ভয় পেয়ে ছিলাম। ঝড় চলে যাবার পরে আমি মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হই। শুধু আমি একা নই জাহাজের সবাই ভীষণ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয় পড়ে। জাহাজের সর্বত্র বিরাজ করতে থাকে অবসাধ ও বিষাদময় বিষণ্ণতা । সব মানুষ কেমন যেন গুটিয়ে যায় । কারো মুখে হাসি ছিল না। সকলে আতঙ্ক গ্রস্থ হয়ে প্রতি নিয়ত আর একটা ঝড়ের আশঙ্কায় দিন গুন ছিল। সমুদ্র একটু উত্তাল হলে বা হাওয়া একটু জোরে বইলেই মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। আমি কিছুতেই কাজে মন বসাতে না পেরে বাড়ি ফিরে আসি। বাড়ি ফিরেও আমার আতঙ্ক যায়নি । রাতে আমি ঘুমাতে পারতাম না। আমাকে মানসিক চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হয় । এই সময় জাহাজ কোম্পানির উচিৎ ছিল আমাদের পাশে দাঁড়ান ও সাহায্য করা । কিন্তু তারা তা করেন নি। উলটে জাহাজে বিভিন্ন ক্ষয় ক্ষতির জন্য আমাদের দায়ী করে । প্রথমেই ক্যাপ্টেন সাহেবের চাকরি চলে যায় ও আমাদের কপালে তিরস্কার জোটে । পেটের দায়ে মেনে নিতে হ’ল।
এবার বলি অন্য কয়েকটা ঝড়ের কথা ।
আমি নিকোবর( পুরান) জাহাজে এক নাগাড়ে তেরো মাস কাজ করেছিলাম। একবার আন্দামান থেকে কলকাতায় আসার পথে বঙ্গোপসাগরে আমরা পড়েছিলাম এক প্রবল ঘূর্ণি ঝড়ের মধ্যে। জাহাজী জীবনে আমি অনেক বার অনেক বড়ো বড়ো ঝড়ের মধ্যে পড়েছি । সে সম্পর্কে বিষদে লিখেছি আমার রহস্য উপন্যাস এম. ভি. জলপরী তে । কিন্তু নিকবর জাহাজে দেখা সে ঝড় অন্য অনেক কারনে খুবই স্মরণীয় । এক তো জাহাজটি ছোট ও পুরনো তাই তার যন্ত্রপাতি গুলো আতি প্রাচীন মান্ধাতার আমলের ছিল। তায় জাহাজটি ছিল কোম্পানির খরচের খাতায়। ক’ দিন পরেই তো তাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে, তাই কি হবে তার পিছনে খরচ করে ? ফলে যতটুকু না করলে নয় তার বেশী তার পিছনে খরচ করা হত না। জাহাজের নেভিগেটিং যন্ত্রপাতি যা ছিল , বা যার সাহায্যে জাহাজটিকে চালিয়ে সমুদ্র পার করে নিয়ে যাওয়া হ’ত, তা শুনলে আজকের দিনের বাণিজ্যিক নৌবহরের নৌ আধিকারিকরা তো বটেই, এমন কি ছোট মাছ ধরার নৌকার মাঝি মাল্লারাও চমকে উঠবেন। নেভিগেটিং ইন্সট্রুমেন্ট বলতে দিক নির্ণয়ের জন্য, আমাদের ওই জাহাজে ছিল একটা ম্যাগনেটিক কম্পাস বা লোহার চুম্বক। দুটি সেক্সট্যান্ট । যা দিয়ে দিনে দুবার জাহাজের অবস্থান বা ল্যাটিটিউড , লঙ্গিটিউড আন্দাজ করা হত। কোন রেডার বা ভি. এইচ .এফ রেডিও ছিল না। জল মাপার ইকো সাউন্ডার মেশিন ছিল না। স্টিয়ারিং করা হত ব্রীজের হুইলের সঙ্গে লাগান চেইন যার অপর প্রান্ত লাগান ছিল জাহাজের হাল বা রাডারের সাথে। তিন দিনের ঝড় আর সাত দিনের প্রবল বৃষ্টিতে , সমুদ্রের ঢেউ লেগে সেই চেইন ছিঁড়ে গিয়ে ছিল। তখন প্রবল ঝড়ে জাহাজের খোলা পুপ ডেকের (সব থেকে পিছনের ডেক) উপর দাঁড়িয়ে বিশাল একটা হুইল, যেটা সরাসরি লাগান ছিল জাহাজের হাল বা রাডারের সঙ্গে তাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমরা স্টিয়ারিং করেছিলাম । সেই হুইলটা এতো বিশাল আর এতো ভারী ছিল যে তিনজন লেগেছিল তাকে সামান্য একটু ঘোরাতে। আর খোলা সমুদ্রের বুকে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো তীরের ফলার মতো বিঁধছিল আমাদের শরীরে। তখন মাত্র বছর দেড়েক হ’ল আমি জাহাজের চাকরিতে ঢুকেছি। ফলে জ্ঞানের দিক থেকে, অভিজ্ঞতার দিক থেকে আমাকে এই চাকরিতে তখন শিশু বলা চলে। অজাত শ্ত্রু শিশুরা যেমন অকুত ভয়ে ঘুরে বেড়ায়, আমিও তেমনি এই ঝড় জলে কি হ’লে কি হতে পারে না বুঝে , নির্ভয়ে খোলা ডেকে ঘুরে বেড়াতাম। নিজের চোখে দেখতাম প্রবল ঝড়ে সেই সুবিশাল জলরাশি বিক্ষুব্ধ হয়ে হাজারটা বাসুকির ফনা হয়ে একশ ফুট লাফিয়ে উঠে জাহাজের গায়ে আছড়ে পড়ত। কখনো বা ঘূর্ণায়মান সেই বিশাল জলরাশি পাক খেয়ে খেয়ে সমুদ্রের বুকে সুগভীর খাদ সৃষ্টি করত। তার সঙ্গে ছিল অবিরাম বৃষ্টি । জাহাজটি ছোট ছিল বলে , একটার পর একটা ঢেউ জাহাজের মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল । জাহাজটা গোঁত্তা খেয়ে ঢুকে পড়ছিল সেই উত্তাল ঢেউ গুলোর ভিতরে। সত্যি বলতে কি জল ঝড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সেই সব পুরন দিনের কথা মনে পড়লে আজ ও আমার শরীরে মনে রোমাঞ্চ জাগে। আজও কালবৈশাখীর ঝড় উঠলে আমি খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির রুদ্র রূপ দেখি। মনে পড়ে যায় সেই দামাল দিন গুলোর কথা সেই অবস্থায় জাহাজের স্টিয়ারিং ব্যবস্থা বা জাহাজকে ডাইনে বাঁয়ে ঘোরানর যন্ত্রটা খারাপ হয়ে গেল । আজকের দিনে জাহাজের এই স্টিয়ারিং ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে । মেইন স্টিয়ারিং যন্ত্র বিকল হলে তৎক্ষণাৎ অন্য একটি ব্যবস্থার সাহায্যে জাহাজ চালান হয়। কিন্তু সে জাহাজে এই দুটি ব্যবস্থাই প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। তবু সেই অবস্থাতেই আমাদের ক্যাপ্টেন সাহেব জাহাজকে কোন ক্রমে গঙ্গার মোহনায় এনে নোঙ্গর ফেলেন। তখন ঝড় থেমে গেলেও জাহাজের পুরন রেডিও যন্ত্র পাতি দিয়ে বার্তা পাঠান যাচ্ছিল না। দিনের বেলা চরম বিপদ সূচক পতাকা তুলে ও রাত্রে এলডিস সিগন্যালিং টর্চ জ্বেলে নিভিয়ে, দুদিন পরে হুগলী রিভার পাইলট ভেসেলে খবর পাঠান গেল। তারা জাহাজের মূল স্টিয়ারিং যন্ত্রটা খারাপ হয়ে গেছে জেনে, জাহাজকে নদী দিয়ে কলকাতা বন্দরে নিতে রাজী হলেন না। পরে বেতার বার্তায় সেটা কোম্পানি কে জানাতে, আদেশ এলো -জাহাজ নিয়ে ভাইজাক বা বিশাখা পত্তনমে চলে যাও । ওই অবস্থায় জাহাজকে ভাইজাকে নিয়ে জাওয়া হ’ল। সেখানে পৌছুতে , দুটি বড়ো বড়ো টাগ বোট এলো জাহাজকে বগল দাবা করে ধরে বন্দরের ভিতরে নিয়ে যেতে। কারন জাহাজের স্টিয়ারিং যন্ত্র খারাপ থাকার ফলে , তাকে নদীতে খাঁড়িতে বা বন্দরে চালান যাচ্ছিল না। জাহাজ সেখানে ক’দিন ছিল তা মনে নেই । তারপর সে জাহাজকে বম্বে নিয়ে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয় । এই ঘটনা ১৯৭৪ সনের ।
# ঘূর্ণিঝড় (৪)
সাউথ আফ্রিকান রোলারস
এই ঘটনাটা ঘটে ছিল ১৯৮৭ সনে যখন আমি বৃটিশ জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করতাম ।
এই ঘটনায় এস ও এস পাঠাতে হয়নি ঠিকই, তবে আর একটু হলেই গিয়েছিলাম। এস ও এস পাঠানোর আগেই উপরে চলে যেতাম। ঝড়ের কথা উঠলেই সবাই বে অফ বেঙ্গল আর বে অফ বিস্কে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের কথা বলে। কিন্তু সাউথ আফ্রিকান কোস্টের ঢেউ তোমরা কেউ দেখেছো কখনো ? সাউথ আফ্রিকান রোলারস আর এ্যাবনর্মাল ওয়েভের নাম শুনেছ ? সেই তার পাল্লায় পড়েছিলাম। আসছি ডারবান থেকে যাব ইস্ট লন্ডনে। প্রবল হাওয়া আর বড়ো বড়ো ঢেউ দু টোই আসছে হেডের উপর থেকে।
হেড মানে রাইট আ হেড । সোজা জাহাজের নাক বরাবর । জাহাজ চলছে অটোমেটিক স্টিয়ারিং এর বদলে হ্যান্ড স্টিয়ারিং এ। আর ইঞ্জিন স্ট্যান্ড বাই। ও ব্যাপারটা তোমরা বুঝলে না? বেশ বুঝিয়ে বলছি । সাধারন অবস্থায় জাহাজ যখন সমুদ্রে অনেক দিন ধরে একই দিকে ফুল স্পিডে চলতে থাকে। তখন ব্রীজে মানে জাহাজের সব থেকে উপরের ঘর (নেভিগেশন্যাল কন্ট্রোল রুম) যেখান থেকে জাহাজকে পরিচালনা করা হয়, সেখানকার জাইরো কম্পাসের (ইলেকট্রিক কম্পাস ) সঙ্গে লাগান স্টিয়ারিং কে একটা দিকে সেট করে রাখা হয় । তারপর সে নিজে নিজে স্টিয়ারিং করে জাহাজকে চালিয়ে নিয়ে যায় । জাহাজের গতির ক্ষেত্রে ও তাই করা হয় । কিন্তু জাহাজ যখন সমুদ্র ছেড়ে কোন নদী নালা বা খাঁড়ি তে ঢোকে, বা আবহাওয়া খুব খারাপ থাকে তখন ইঞ্জিনের গতিবেগ ঘন ঘন কমাতে বাড়াতে হয় । স্টিয়ারিং ও বিভিন্ন দিকে ঘোরাতে হয় । তখন ওই দুটোই আর অটোমেটিক বা নিজে নিজে চলতে পারে না। তাদের তখন হাতে নিয়ে চালাতে হয় । তাই জাহাজ তখন হাতের দ্বারাই চলছিল।
আমি স্টিয়ার করছি বা জাহাজকে চালাচ্ছি ১৮০ ডিগ্রীর মতো মানে দক্ষিণে। হুইল হাতে স্টিয়ারিং করছে একজন হেল্মস ম্যান। ঝড় বইছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। জাহাজের স্পীড দশ থেকে কমে চারে নেমেছে। স্পিডমিটারের দিকে তাকিয়ে দেখছি যে স্পীড ক্রমশ কমে আসছে। দুপুর দুটোর সময় দিনের আলো এতো কমে গেছে যে মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ডান দিকে স্টারবোর্ড সাইডে মাইল দুই দূরে কিনারা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ সামনে থেকে ভেসে এলো সেই বিখ্যাত সাউথ আফ্রিকান রোলারস ।
রোলারস জিনিষটা কেমন? লাইন দিয়ে আসে ছোট ছোট সারি সারি ঢেউ। দেখতে অনেকটা গাড়ির রাস্তার স্পীড ব্রেকার বা বাম্পারের মতো। কোন টার হাইট তিন ফুটের বেশি হবে না। কিন্তু লাইন দিয়ে আসছে তো আসছেই। একটা ধাক্ক মারবার সাথে সাথে আর একটা এসে ধাক্কা মারছে। গোঁত্তা খেতে খেতে জাহাজের স্পীড কমে দু নটে দাঁড়িয়েছে। স্টারবোর্ড বাও য়ে (জাহাজের ডান দিককে স্টারবোর্ড সাইড বলে) দেখছি একটা পাহাড় ক্রমশ এগিয়ে আসছে। জাহাজ এগিয়ে চলেছে। পাহাড়টা ঠিক যখন ডান দিকের বীমে, মানে গা বরাবর খুব কাছে , সামনে থেকে উঠল প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু একটা ঢেউ। এমন জোরে ধাক্কা মারল জাহাজের গায়ে, যে জাহাজটা বোঁ করে ডান দিকে মানে সেই পাহাড়ের দিকে ঘুরে গেল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম “ হার্ড এ পোর্ট” মানে হুইলটা পুরো বাঁ দিকে ঘোরাও । হেল্মস ম্যান ( যারা জাহাজের হুইল ধরে) সঙ্গে সঙ্গে প্রান পণে হুইলটাকে বাঁ দিকে ঘোরাল। কিন্তু জাহাজ ঘুরল না। সেই পাহাড়ে দিকেই এগিয়ে যেতে থাকল। বুঝলাম যে স্টিয়ারিং কাজ করছে না। জাহাজ ঘুরছে না। সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু। আমার হাত পা অবশ হয়ে গেছে। এখন কি যে করা উচিৎ ভেবে পাচ্ছিনা। আমি ভয়ে বিহ্বল ভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। জাহাজটা ক্রমশ সেই পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। পাহাড়টা আরো আরো কাছে এগিয়ে আসছে। পিছন থেকে ভেসে এলো মৃদু কণ্ঠের কঠিন আদেশ- “ হারড এ স্টারবোর্ড” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ক্যাপ্টেন সাহেব । সঙ্গে সঙ্গে আমি হেল্মস ম্যানকে বললাম স্টিয়ারিং ফুল ডান দিকে ঘোরও। সেই সময় আমার চিন্তা শক্তি কাজ করছিল না। আমি শুধু হুকুম মেনে কাজ করছি । না হলে ডান দিকে যেখানে পাহাড়টা একেবারে সামনে এসে গেছে, সে দিকে আমি জাহাজ ঘোরাব কেন ? কিন্তু কি আশ্চর্য জাহাজ পরিষ্কার ডান দিকে ঘুরে গেল। ক্যাপ্টেন উল্টো দিকে জাহাজ ঘুরিয়ে আমায় নর্থ ইস্টে জাহাজ চালাতে বললেন। আর বললেন জাহাজের স্পীড হাফ করে দিতে। বিপদ কেটে বেরিয়ে যাবার পর, ক্যাপ্টেন সাহেব শীষ দিতে দিতে পাইলট চেয়ারে গিয়ে বসে বললেন- এখন থেকে আমি টেক ওভার করলাম তুমি চা বানাও।
এক একটা ক্যাপ্টেন যেমন খুব গম্ভীর হয় , ক্যাপ্টেন জনসন কিন্তু তেমন ছিলান না। কেউ কোন দিন ওনাকে রাগতে দেখে নি। সে জন্যে আমরাও ওনার সঙ্গে ফ্রীলি কথা বলতাম। আমি বললাম – কিছু মনে করবেন না স্যার আপনি যে এ্যাকশান গুলো নিলেন, তার কোনটাই আমি বুঝতে পারিনি। আমরা তো যাচ্ছিলাম ইস্ট লন্ডনে, সেটা দক্ষিণ দিকে। কিন্তু আপনি জাহাজকে উত্তর দিকে ঘুরিয়ে দিলেন কেন ? তারপর হঠাৎ স্পীডটা ও কমিয়ে হাফ করে দিলেন কেন ? ক্যাপ্টেন সাহেব বললেন – সরি সেকেন্ড মেট। এগুলো আমারই উচিৎ ছিল তোমায় জানান। কারন তুমিই ওয়াচ অফিসার। আচ্ছা বারটার সময় তুমি যখনওয়াচে এলে তখন জাহাজের স্পীড কতো ছিল? – ফাইভ নট স্যার। – আর জাহাজ যখন ডান দিকে সুইং করল তখন কতো ছিল? – দেখিনি স্যার, বোধহয় দু নট হবে। – সেই সিচুয়েশনে না দেখাটাই স্বাভাবিক, তবু তোমার দেখা উচিৎ ছিল। জাহাজের স্পীড ওই সময় জিরো নট হয়ে গিয়ে ছিল। অর্থাৎ জাহাজ তখন ঝড় ঠেলে আর এগুতে না পেরে থেমে গিয়েছিল । তাই স্টিয়ারিং কাজ করেনি। আমি বললাম –কিন্তু আমি যে দেখলাম ওই পাহাড়টা কাছে এগিয়ে আসছিল ?
ক্যাপ্টেন সাহেব বললেন –তুমি কি রেডারে দেখেছিলে ?
আমি আমতা আমতা করে বললাম – মানে ওই পাহাড়টা এতো কাছে এসেগিয়েছিল যে আমি আর চিন্তা করতে পারছিলাম না।
-এই যে কাছের কথাটা তুমি বলছ ? ওটা অপটিক্যাল ইলিউশান বা দৃষ্টি বিভ্রম। এই আবহাওয়া ও আলোকে তা স্বাভাবিক । তাই রেডারে দেখতে হয় । কিন্ত সব চেষ্টার একটা সীমা আছে। জীবন যুদ্ধেও যখন দেখবে কোন কাজ বহু দিন ধরে চেষ্টা করেও হচ্ছে না। হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। তখন সেই কাজ ছেড়ে অন্য কাজ করা উচিৎ। অবশ্য বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকলেও লেগে থাকা উচিৎ । আমি যখন দেখলাম যে আর আগে যাওয়া যাচ্ছে না, তখনি আমি মনস্থির করলাম আবার ডারবানে ফিরে যাওয়ার। কারন ওই ঝড় ঠেলে আগে যাওয়া যাবে না। তাছাড়া একটু মমেন্টাম না থাকলে বা জাহাজ থেমে গেলে, রাডার রেস্পন্ড করবে না বা সুকান সাড়া দেবেনা। তাই জাহাজের সুইংটা যেদিকে ছিল , সেই দিকেই আরও বেশি করে ঘোরালাম। জাহাজ ঘুরে গেল, আর পিছন থেকে হাওয়ার ঠ্যালা পেয়ে , স্টিয়ারিং ও রেস্পন্ড করল বা হালে পানি পাওয়া গেল।
– – তা না হয় বুঝলাম স্যার, কিন্তু হাফ স্পীড করলেন কেন ?
– – কারন এখান থেকে আমি ডারবানে ফিরে গিয়ে নোঙর করব। ঝড়ের জন্য একটা বাড়তি স্পিড তো এমনিতেই পাবো । শুধু শুধু আমার তেল পোড়াই কেন ? তাছাড়া চীফ অফিসারের এ্যাঙ্কার পার্টিকে তৈরি হওয়ার জন্য সময়ও তো দিতে হবে ।(জাহাজের নোঙর ফেলার কাজটা চীফ অফিসার করে )। আমি ভীষণ অবাক হয়ে বললাম যে এই এতো সব আপনি অতো তাড়াতাড়ি ভেবে নিয়ে ছিলেন স্যার?
– সেটাই আমার কাজ মাই বয় । আই এ্যম পেইড ফর দ্যাট ।