‘দানে বাড়ে ধন, যদি থাকে মন।’
ধন থাকলেই দান করা যায় না। দান করতে হলে মন থাকা চাই। আর তাই প্রবাদে বলা হয়, ‘আল্লাহ দিয়া ধন বুঝে মন, কাইড়া নিতে কতক্ষণ।’
দানশীলতার প্রতিশব্দ হলো- উদারতা, বদান্যতা ও মহত্ব ইত্যাদি। অন্যের প্রতি দয়াপরশ হয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে নিজ মন থেকে তাদেরকে কিছু দেওয়াই হলো দান। প্রকৃত দানশীল ব্যক্তি উপযুক্ত পাত্রে, নিজ অন্তর থেকে কোনোরূপ ‘রিয়া’ (লোক দেখানো) ব্যতিরেকে উত্তম মাল অতি গোপনে দান করে থাকেন। দান করার পর উক্ত গ্রহীতার নিকট দানের কোনো বিনিময় আশা করেন না বা লোকের নিকট বলে বেড়ায় না। এটিই হলো- উত্তম দানশীলতার নমুনা।
মানুষের কল্যাণে দান-সদকাহর ব্যাপারে আল কোরআন বিভিন্নভাবে নির্দেশ দিয়েছে। বলেছে উৎসাহের কথা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ! তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয় তারাই তো মহাক্ষতির মুখোমুখি হয়। আমি তোমাদের যেসব রিজিক ও সম্পদ দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। যদি তা না কর তাহলে মৃত্যুর সময় তোমাকে বলতে হবে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছু মুহূর্ত সময় দাওনি কেন? তাহলে আমি আমার সব সম্পদ তোমার পথে মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সুরা মুনাফিকুন আয়াত ৯-১০) আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা আয়াত ১৯৫)।
আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দানশীলতার অনন্য প্রতীক। তিনি কখনও কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। হাদিসের ভাষ্যমতে, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা ও সর্বাধিক সাহসি।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম। নিজের কষ্টার্জিত সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দেওয়া সর্বাধিক সাহসের কাজ। আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা.) প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলেই কেবলমাত্র তা সম্ভব হয়।
বিশ্বের ১৪৫টি দেশের উপর পরিচালিত এই জরিপের বরাত দিয়ে মঙ্গলবার গবেষকরা জানিয়েছেন, সবচেয়ে উদার মানুষের দেশের তালিকায় এবার সবার উপরে রয়েছে মিয়ানমার। এই তালিকায় সবার নিচে আছে বুরুন্ডি। আর এর উপরে আছে যথাক্রমে চীন, ইয়েমেন ও লিথুয়ানিয়া। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯৫ নম্বরে। কোন দেশের মানুষ কতোটা দানশীল, স্বেচ্ছাসেবী কাজে কতোটা যুক্ত এবং আগন্তুকদের কতোটা সাহায্য করেন তার উপর ভিত্তি করে ‘ওয়ার্ল্ড গিভিং ইনডেক্স’ নামের এই তালিকা প্রকাশ করেছে সিএফএ। এতে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ৯ জনই দান করেন এবং কমপক্ষে ৫ জন স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে যুক্ত। সিএএফ এর হিসেবে, ২০১৪ সালে বিশ্বের ১৪০ কোটি মানুষ অন্যকে দান করেছেন। দানশীলদের এই সংখ্যা বিশ্বের মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে এই হার ছিল ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এক বিবৃতিতে সিএএফ এর প্রধান নির্বাহী জন ল বলেন, “বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এই সময়েও অন্যের সাহায্যে অর্থ দানের প্রবণতা বাড়ার এই চিত্র খুবই আশাব্যঞ্জক।” সিএএফ এর ‘ওয়ার্ল্ড গিভিং ইনডেক্স’ অনুসারে সার্বিক দানের বিচারে তালিকায় মিয়ানমারের পরই আছে যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া।
সর্বকালের সেরা ধনীর সম্পদের খেতাবের মালিক মানসা মুসা, ১৪ শতকে পশ্চিম আফ্রিকার এই মুসলিম শাসক এতটাই ধনী ছিলেন যে তার দানশীলতার কারণে একটি পুরো দেশের অর্থনীতিতে পর্যন্ত ধস নেমেছিল। “মুসার সম্পদের যে শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে আসলে তিনি যে কতটা সম্পদশালী এবং ক্ষমতাশালী ছিলেন তা ধারণা করাও কঠিন,”- বিবিসিকে বলেন রুডলফ বুচ ওয়ার, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ১২৮০ সালে একটি শাসক পরিবারেই জন্ম মানসা মুসার। তিনি ক্ষমতায় আসার আগে মালি সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন তাঁর ভাই মানসা আবু-বকর। ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে আবু-বকর সিংহাসন ত্যাগ করে একটি অভিযানে বের হন। তাঁর রাজত্ব বিস্তৃত ছিল ২,০০০ মাইলজুড়ে, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে শুরু করে বর্তমান নিজার, সেনেগাল, মৌরিতানিয়া, মালি, বুর্কিনা ফাসো, গাম্বিয়া, গিনি-বিসাউ, গিনি এবং আইভোরি কোস্টের বড় অংশ ছিল তার রাজত্বে। মানসা মুসা তার তীর্থযাত্রায় যে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ খরচ অথবা নষ্ট করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তার এই অতি দানশীলতাই তাকে বিশ্বের নজরে এনে দেয়। মানসা মুসা আক্ষরিক অর্থেই মালি এবং নিজেকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দেন।
বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ আছেন, যাঁরা বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেছেন এবং নিজেদের অঢেল ধনসম্পদের পুরো কিংবা অর্ধেকই দান করে দেওয়ার অঙ্গীকার করে রেখেছেন। বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটস ও তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস বিশ্বের সবচেয়ে বড় দানশীল দম্পতি। তাঁরা এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কোটি ডলার দান করেছেন। দাতব্য কাজের জন্য তাঁরা নিজেদের নামে গঠন করেছেন বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। বর্তমানে এই ফাউন্ডেশনের মোট ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে গেটস দম্পতি ভালো সব কাজে দান করে থাকেন। তাঁরা নিজেদের ধনসম্পদের অর্ধেকটাই দান করে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে রেখেছেন।
জনপ্রিয় সামাজিক মিডিয়া ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ বিশ্বের এযাবৎকালের কনিষ্ঠতম শীর্ষ ধনী। তাঁর সম্পদের নিট মূল্য ৭ হাজার কোটি ডলার। তিনি ও তাঁর স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান মিলে এ পর্যন্ত জনহিতকর কাজে ২০০ কোটি ডলারের বেশি দান করেছেন। সবচেয়ে বড় খবর হলো, এই দম্পতি জীবদ্দশাতেই তাঁদের মোট ধনসম্পদের ৯৯ শতাংশই দান করে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন।
দানের প্রতিদান সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি দান গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও তবে তা তোমাদের জন্য আরও ভালো। আল্লাহ তোমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। সমাজের বিত্তবানরা জনহিতকর কাজ যেমন মক্তব-মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, বিদ্যালয় স্থাপন, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ বা সংস্কার, হাসপাতাল নির্মাণ, লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা, বিশ্রামাগার, অজু-গোসলখানা নির্মাণ, খাল খনন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় প্রদান, হতদরিদ্র, পথশিশু, পঙ্গু, অন্ধ, অক্ষম এবং অসহায় লোকের পুনর্বাসন, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি হিতকর কাজ করতে পারেন।
দুঃখ হয় যখন দেখি, এই আধুনিক যুগে ইন্টারনেটের কারসাজিতে দানের নামে প্রচার আর দান নিয়ে প্রতিযোগিতা, পাশাপাশি দানের টাকায় সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠা। স্বার্থের দ্বন্দ্বে একে অন্য দাতা ফাউন্ডেশন বা ব্যক্তিকে অপমানিত করা আর সুযোগের অপেক্ষায় ছোট কোন ভুলের জন্য টেনেহিঁচড়ে নামানোর চেষ্টায় লিপ্ত হওয়া। বাঁচার প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহে যেমন ধর্ম পরিচয়ে হয়না, তেমনি দানেও ধর্ম নয় মানুষ হিসেবে তার পরিচয় হওয়াই অতি উত্তম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা আছেন, ভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন কোম্পানিতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মালিকের অধিনে তারা চাকরি করছেন এবং মাস শেষে বেতন পাচ্ছেন, আর সেই টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন। এখানে তার পরিশ্রমে কর্মের দ্বারা উপার্জন একজন মানুষ হিসেবে, ধর্ম পরিচয়ে নয়। তাই দান করুন একজন মানুষকে, তার পরিচয় বর্তমানে তিনি একজন হত দরিদ্র মানুষ। দানশীল ব্যক্তি জান্নাতের ছায়ায় অবস্থান করে।
*** কয়েকজন ইসলামবিষয়ক লেখক ও কয়েকজন কলামিস্টগণের আর্টিকেল থেকে সংগ্রহ।